ওএমএসের ট্রাক থেকে চাল নিতে এসে জ্ঞান হারালেন গোলাম মোস্তফা
মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে সিটি মাঠসংলগ্ন সড়কে আজ বৃহস্পতিবার প্রভাতকালে খোলাবাজারে চাল-আটা বিক্রির (ওএমএস) ট্রাকের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ১টি বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী মোস্তফা খান। উনি যখন লাইনে দাঁড়ান, তখন সকাল বেলা নয়টার মতো বাজে।
দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে সমস্যা হলেও কষ্টে পাওয়া সিরিয়াল ছেড়ে দূরে সরতে পারছিলেন না গোলাম মোস্তফা। একপর্যায়ে বেলা ১১টার দিকে লাইনের পাশেই অচেতন হয়ে পড়ে যান তিনি।
পরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন মোস্তফাকে ধরাধরি করে রাস্তার পাশে শুইয়ে দেন। এ টাইম কেউ তাঁর মাথায় পানি দিচ্ছিলেন। কেউ তাঁর ফোন নিয়ে স্বজনদের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। একজন জাতীয় তাৎপর্যপূর্ণ সার্ভিস নম্বর ৯৯৯-এ কল করে তাদের সহায়তাও চান। প্রায় আধা ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে চক্ষু মেলেন চাকর মোস্তফা। অথচ তখন কথা বলার মতো সিচুয়েশনে ছিলেন না তিনি।
চাকর মোস্তফার নাম জানা যায় জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে। আর সঙ্গে থাকা মুঠোফোনে মেলে পরিজন সদস্যের নম্বর। পরে ওই স্থান উপস্থিত মানুষের ভিতরে দুজন এগিয়ে এলেন। তাঁকে রিকশায় করে পৌঁছে দিলেন মিরপুর ১২-এর সি ব্লকের ২ নম্বর পথের বাসায়। ১ম আলোর প্রতিবেদক সেই সময় পেছন পেছন সেই বাসায় যান।
সেখানে পৌঁছে কথা হয় ভৃত্য মোস্তফার সহকর্মী লাল মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁরা দুজনে পালা করে ওই বাসায় নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন। মোস্তফার বিবি কাজ করেন একটি পোশাক কারখানায়। ছেলেও একটা ছোটখাটো কাজ করে নিজের ব্যয় চালায়। স্ত্রীকে নিয়ে পাশেই ছোট একটি বাসায় ভাড়া থাকেন তিনি।
লাল মিয়া আরও জানান, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত চাকর মোস্তফার দুই দিন ধরে পাতলা পায়খানা চলছে। অথচ অভাবের সংসারে সুলভ মূল্যে চাল পেতে আজ ভোরে অসুস্থ শরীর নিয়েও উনি ওএমএসের লাইনে দাঁড়ান।
‘এখন তো তাকে অসুস্থ সিচুয়েশনে নিয়ে এল। ওনার স্ত্রীকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। উনি গার্মেন্টস থেকে ছুটি নিয়ে আসতেছেন,’ ১ম আলোকে বললেন লাল মিয়া।
যে ট্রাক থেকে অন্ন কিনতে গিয়ে ভৃত্য মোস্তফা জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিলেন, সেটা খাবার অধিদপ্তরের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় খোলাবাজারে বিক্রি বা ওপেন মার্কেট শক্তিস্তরের (ওএমএস) ট্রাক। এসব ট্রাকে করে বাজারের তুলনায় কিছুটা কম দামে চাল ও আটা বিক্রি করা হয়।
একসময় ওএমএস কর্মসূচিতে বিক্রি করা পণ্যের নিমিত্ত ক্রয়কারী ছিলেন একেবারে স্বল্প ইনকামের মানুষ। কিন্তু মার্কেটে নিত্যপণ্যের দর বৃদ্ধিতে থাকায় দিন দিন ওএমএসের পণ্য কিনতে আসা মানুষের পরিমান বাড়ছে। ফলে দীর্ঘ হচ্ছে নিম্নবিত্ত, স্বল্প আয় তার সাথে প্রচুর ক্ষেত্রে মধ্যম আয়ের মানুষের সারি।
সরকার ওএমএসের সাহায্যে প্রতি কেজি চাল ৩০ টাকায় বিক্রি করে। প্রতি কেজি উন্মুক্ত করা আটা বিক্রি হলো ২৪ টাকায়। আর ২ কেজির প্যাকেটজাত আটা বিক্রি হলো ৫৫ টাকায়। একজন ক্রয়কারী মেক্সিমাম ৫ কেজি চাল ও ৫ কেজি খোলা আটা বা ৪ কেজি প্যাকেটজাত আটা কিনতে পারেন।
ওএমএস ট্রাকের সম্মুখে মানুষের দীর্ঘ সারি এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে যে বাজারমূল্যে ইদানিং অনেকেই পণ্য কিনতে পারছেন না। ফলে গরিবের জন্য যে কর্মসূচির আয়োজন, তাতে এসে যোগ দিচ্ছেন মধ্যবিত্ত মানুষেরাও।
ওএমএসের লাইনে দাঁড়িয়ে চাল-আটা নিতে আসা মানুষের ভিতরে কথা-কাটাকাটি অনেকটা নৈমিত্তিক ঘটনা। মাঝেমধ্যে তা মারামারির পর্যায়েও পৌঁছায়। আর অনেক সময় চাকর মোস্তফার মতো কেউ কেউ দুর্ঘটনারও শিকার হন।
এ রকমই একজন দিনমজুর জাহিদ হাসান। মাস তিনেক আগে ওএমএসের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তবুও যখন লরি আসে, সেই সময় সকলেই হুড়োহুড়ি করে দৌড় দেয়। এতে পড়ে গিয়ে ও অন্যদের পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে হাঁটুতে সাংঘাতিক ঘা পান তিনি। পরে বেশ কিছুদিন বাসায় বিশ্রামে থাকতে হয় তাঁকে।
‘সে টাইম চিকিৎসা করতে হলে গিয়ে দেড় হাজার টাকা হয়ে গিয়ে ছিল আমার। কয়েকটি টাকা বাঁচানোর আশায় লাইনে দাঁড়িয়ে আরও ব্যয় বেড়েছিল তখন,’ জাহিদ হাসান যখন ১ম আলোকে এ কথা জানান, সেই সময় উনি মিরপুরে ওই ট্রাকের লাইনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।
জাহিদ হাসান ও ক্রীতদাস মোস্তফার ক্ষেত্র যা ঘটে গেছে, তা প্রচণ্ড একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। স্বল্পমূল্যে খাদ্যপণ্য কেনার জন্য পর্যাপ্ত স্বল্প রোজগারের লোক সম্প্রতি মরিয়া হয়ে উঠেছেন বলে ধারণা, ফলে মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
No comments