Header Ads

কালকের দিনটি কেন বিশেষ

কালকের দিনটি কেন বিশেষ

কাল ১৪ মার্চ, পাই দিবস। গণিতের ধ্রুবকটি কেমন করে সাইন্সের বিশ্বে একটা বিশেষ ঠাঁই করে নিল? ঘটা করে পাই দিবস উদ্‌যাপনের তাৎপর্যই-বা কী? লিখেছেন বোস্টন সায়েন্টিফিকের প্রকৌশলী আশ্চর্য হাসান। গণিতপ্রেমী হিসেবেই অবশ্য তিনি বহু পরিচিত। অনলাইনে চমকের গণিতবিষয়ক ভিডিওগুলো বেশ জনপ্রিয়।

২০০৬ বছরের শুরুর দিকের কথা। আঞ্চলিক উৎসবে অংশ নিতে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সহসভাপতি মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার, সাধারণ এডিটর মুনির হাসান এবং আমরা কয়েকজন মুভার (গণিত অলিম্পিয়াডের স্বেচ্ছাসেবক) ফরিদপুর যাচ্ছিলাম। আমি সেই সময় বুয়েটে প্রথম বর্ষে পড়ি। সুযোগ পেয়ে জাফর ইকবাল স্যার, মুনির ভাইকে ১৬০ আবাস পর্যন্ত পাইয়ের মান শুনিয়ে দিলাম, তখন ওই পর্যন্তই মুখস্থ ছিল।

একচোট হাসাহাসির পর মুনির হাসান জানালেন, এই সময়ে পাই দিবস আয়োজন করা যায়, ওই জায়গা পাই মুখস্থবিদদের ডাক দেওয়া হবে।


ব্যস! এভাবেই ২০০৬ বছরের ১৪ মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আয়োজিত হচ্ছে পাই দিবস। আচ্ছাদন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথমেটিক্স আলয় থেকে একটা র‍্যালি হলো। র‍্যালি শেষে পাইয়ের ছবিওয়ালা বড় একটা কেক খনন করা হলো। পাই নিয়ে পুঁথি পাঠ হলো। পাইয়ের মান বলার প্রতিযোগিতা হলো।


তত দিনে আমি ৩২৭ ঘর পর্যন্ত শিখে ফেলেছি, ওটাই ছিল সে সময়ের রেকর্ড। আজকাল অবশ্য আমি নিজেই কয়েকজনকে চিনি, যাঁরা দশমিকের পর কয়েক হাজার বাড়ি জানেন। আর সারা জগতের রেকর্ড—দশমিকের পর এক লাখের ওপরে (আকিরা হারাগুচি, জাপান, ২০১৫)!


পাই ব্যাপারটা কী?


আমি জানি, অনেকের মনের ভেতরই কতিপয় প্রশ্ন উঁকি দিতে আরম্ভ করেছে। পাই কী জিনিস, আর সেটি নিয়ে কেন মাতামাতি। এমন এমনি মুখস্থ করার কোনো মানে আছে?


পাইয়ের পরিচয়টাই প্রথমে দিই। পাই একটা গাণিতিক ধ্রুবক। আমরা তো সকলেই বৃত্ত চিনি। একটা বৃত্তের কোনো একটা বিন্দু থেকে হাঁটা চালু করে একটানা বৃত্তটা ঘুরে যদি আবার আগের বিন্দুতে পৌঁছানো যায়, তাহলে যতটুকু পথ হাঁটা হবে, সেই দূরত্বকে বলে বৃত্তের পরিধি।


আর আমরা যদি বৃত্তের ওপরের একটা বিন্দু থেকে চালু করে কেন্দ্র বরাবর সোজাসুজি হাঁটতে শুরু করি, আর তারপর কেন্দ্র লঙ্ঘন হয়ে উল্টো পাশের বিন্দুটা পর্যন্ত হাঁটি, যত মুছে হাঁটা হবে, সেই দূরত্বকে বলে বৃত্তের ব্যাস।


এবার একটা ব্যাপার মনে করা যাক। আমরা যদি একটা বৃত্তকে চারপাশ হতে টেনে বৃহৎ করে পূর্বের দুই গুণ বানিয়ে ফেলি, তাহলে এর পরিধি উদাহরণসরূপ দুই গুণ হয়ে যাবে, ব্যাসও দুই গুণ হয়ে যাবে। আবার চেপেচুপে অর্ধেক বানালে, পরিধি আর ব্যাস দুটোই অর্ধেক হয়ে যাবে। এদের ভাগফল তবুও সেইম থাকবে। একটা বৃত্ত যত বড় বা যত ছোটই হোক না কেন, এর পরিধিকে ব্যাস দিয়ে ভাগ করলে সব টাইম একই পরিমান পাওয়া যায়। সেই সংখ্যাটাকেই জানানো হয় পাই।


কিন্তু পাইয়ের মান আসলে কত?


এখন আমরা জানি যে পাইয়ের মান ৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫৮৯৭৯৩২…এভাবে অনন্তকাল চলতে থাকবে,  সম্পন্ন হবে না। স্মার্ট পিসি দিয়ে অল্পসংখ্যক লাখ কোটি আবাস পর্যন্ত মান বের করা হয়েছে, এইরকম হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এ যাত্রার শুরুটা  হাজার বছর আগে। প্রাচীন মিসর আর ব্যাবিলনের মানুষদের পাই নিয়ে ঈষৎ অনুমান ছিল। তারা মেপে বের করেছিল এটার মান ৩-এর কাছাকাছি। অথচ গাণিতিকভাবে বের করার কোনো ট্রাই জানা যায় না।


২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রাচীন জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ আর্কিমিডিস বৃত্তকে বহুভুজ দিয়ে ধারণা করে প্রুফ করলেন যে পাইয়ের মান হবে ২২৩/৭১ হতে ২২/৭ এর ভেতরে। তাঁর বলা সেই ২২/৭ এখনো পাইয়ের ধারণা পরিমাণে ব্যবহারকৃত হয়। পাই কিন্তু আসলে ২২/৭ নয়, তার চেয়ে একটু ছোট। যা হোক, আর্কিমিডিসের কাছ হতে দশমিকের পর দুই বাড়ি পর্যন্ত ঠিকঠাক মান পাওয়া গেল। তাঁর দেখানো পথ ধরে আরেকটু নিখুঁত ধারণা বের করলেন চীনা গণিতবিদেরা, ৭ আবাস পর্যন্ত মান পাওয়া গেল তখন।


খ্রিষ্টাব্দ ১৪ শতকে ভারতীয় গণিতবিদ মাধব চিরস্থায়ী ধারার ধারণা দেওয়ার পর পাইয়ের মান বের করার ব্যাপারটা নতুন গতি পেল। ১৬ শতকে আইজ্যাক নিউটন তাঁর ক্যালকুলাসের অনুমান প্রয়োগ করে বের করলেন ১৫ ঘর পর্যন্ত। গণিতবিদেরা পাইয়ের মান আরও নিখুঁত করে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। তখনো ক্যালকুলেটর বা পিসি তৈরি হয়নি, একারণে কাজটা ছিল দারুণ শ্রমসাধ্য আর সময়সাপেক্ষ। উইলিয়াম শ্যাঙ্কস জীবনের একটা বড় টাইম খরচ করে বের করলেন ৭০৭ আবাস পর্যন্ত, তা সত্ত্বেও পরে দেখা গেল ৫২৭ ঘরের পরে সবই ভুল!


আমরা যাকে ‘পাই’ বলে বর্তমান এক নামে চিনি, সেই সংখ্যাটাকে ‘পাই’ নামে ১ম ডেকেছিলেন উইলিয়াম জোনস, ১৭০৬ সালে। ১৭৬০ সালে ল্যাম্বার্ট প্রমাণ করলেন পাই একটা অমূলদ সংখ্যা। দুটো পূর্ণসংখ্যার ভাগফল পরিমাণে এটাকে কোনো দিনও পাবলিশ করা যাবে না। দশমিকের পরে এটাকে লিখে কোনো দিনও সম্পন্ন করা যাবে না।


যদি জানিই যে এটি কোনো সময়েই সমাপ্ত হবে না, তাহলে এত আবাস বের করার রিজন কী? আর এত আবাস মুখস্থ করারই-বা কী দরকার?


সত্যিটা হলো, মুখস্থ করার আসলেই কোনো মানে নেই। দশমিকের পর প্রচুর আবাস বলতে পারা আলাদা করে কোনো গণিত-প্রতিভা নির্দেশ করে না। এখানে যেটা আছে, সেটা হলো স্রেফ নির্দোষ আনন্দ। এর বেশি কিছু নয়। দশমিকের পর হাজার কক্ষের কোনো প্রায়োগিক ব্যবহার নেই, এজন্য মান বের করার ভেতরেও আনন্দটাই মুখ্য ছিল এত দিন। বর্তমান একটা কম্পিউটারের গণন-ক্ষমতা কতটা শক্তিশালী, সেটি এক্সামের একটা উপায় হতে পারে পাইয়ের মান বের করা।


পাই-ই কেন? কোথায় কাজে লাগে এটা


যদিও পাইয়ের শুরুটা ছিল একটা সাধারণ ধ্রুবক হিসেবে, পরে লক্ষ্য গেল সব জায়গায় অপ্রত্যাশিতভাবেই চলে আসে পাই। বৃত্ত-উপবৃত্তের ক্ষেত্রফল, অবয় ধারার যোগফল, পরিসংখ্যানের নরমাল ডিস্ট্রিবিউশন, পদার্থবিদ্যার জলপ্রবাহ সমীকরণ, অনিশ্চয়তা নীতি, রসায়ন, প্রকৌশল পক্ষান্তরে অয়লারের অনিন্দ্য ভালো অভেদক (eiπ+1=0), কোথায় নেই পাই! এইরকম সব কারণে পাই গণিতবিদদের দুর্দান্ত আগ্রহের টপিক হয়ে ছিল সব সময়ই। এজন্য বলে দিবস বানিয়ে ঘটা করে উদ্‌যাপন করা হবে, এ ধারণা তা সত্ত্বেও বহু আগের নয়।


১৪ মার্চ কেন পাই দিবস?


যুক্তরাষ্ট্রে তারিখ লেখার টাইম প্রথমে মাস লেখে, অতঃপর দিন। পূর্বেই বলেছি, পাইয়ের মান হচ্ছে ৩.১৪১৫৯…। এর হতে প্রথম তিন অঙ্ক নিলে পাওয়া যাবে ৩.১৪। এটাকে মার্কিনদের মতো করে আশা করা যায় মার্চের ১৪ তারিখ। ১৯৮৮ সালে মার্কিন পদার্থবিদ ল্যারি শ প্রথমবারের মতো পাই দিবস ব্যবস্থা করলেন সানফ্রান্সিসকো শহরে। সেখানে একটা রংচঙা প্যারেড হলো, আর প্যারেড শেষে সকলেই মিলে ‘পাই (pie)’ নামের মিষ্টান্ন খেল। তারপর আস্তে ধীরে সারা বিশ্বের গণিতপ্রেমী মানুষদের ভেতরে ১টি জনপ্রিয় দিবস হয়ে উঠল এই পাই দিবস। সংখ্যার কোনো একটা ব্যাপার নিয়েও যে একটা দিবস থেকে পারে, উৎসব হতে পারে, এটাই তো দারুণ। ম্যাথমেটিক্স সেই সময় বইয়ের পত্র থেকে এসে আমাদের আনন্দময় সংস্কৃতির অংশ হয়ে যায়। এই দিনে কেউ পাই মিছিল বের করে, কেউ ‘পাই’ খায়, কেউ গণিত নিয়ে গান বাঁধে, স্কুলে শিক্ষকেরা বাচ্চাদের সাথে অঙ্ক আর সংখ্যা নিয়ে খেলেন, পাইয়ের গল্প শোনান, পোশাকের দোকানে সংখ্যার নকশাওয়ালা জামা বিক্রি হয়, পাইয়ের মান মুখস্থ বলার প্রতিযোগিতাও হয় কোথাও।


অঙ্ক নিয়ে মাতামাতি, অঙ্কের প্রতি মোহ—এসব আপাতদৃষ্টে অর্থহীন মনে হতে পারে। তা সত্ত্বেও এ থেকে যে ভালোবাসা আর একাগ্রতার উদ্ভব হয়, সেটির ফল সুদূরপ্রসারী। পাই দিবস সংখ্যার প্রতি ভালোবাসা উদ্‌যাপনের দিন, আর একারণে সংখ্যাপ্রেমী মানুষের নিকট বিশেষ আনন্দের দিন! আর এ দিনটিতেই আমাদের সুপ্রিম বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিন, তাই আনন্দের মাত্রাটাও দ্বিগুণ।

No comments

Powered by Blogger.